নীলরতন সরকার মেডিকেল স্কুল ও কলেজের ১৫০ উদযাপন পূর্তি

রিপোর্ট:দেবলীনা দত্ত

সমাজে আধুনিক চিকিৎসার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং সিপাহী বিদ্রোহ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনের অবসানের পর বৃটিশ রাজের ভাবমুর্তি উজ্জ্বলকারী বিভিন্ন প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে শিয়ালদহ মিউনিসিপাল মার্কেট হাসপাতালকে ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তি সময়ে ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে এটি ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজে উন্নিত হয় এবং স্বাধীনতার পর ১৯৫০এ হাসপাতালটিকে বাংলা তথা ভারতের গর্ব অন্যতম উজ্বল তারকা চিকিৎসক ও কলেজের প্রাক্তন কৃতি ছাত্র স্যার নীলরতন সরকারের নামাংকিত করা হয়। সেদিন যে চারাগাছটি রোপিত হয়েছিল দেড়শ বছরের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজ সেটি দেশের অন্যতম প্রধান মেডিক্যাল কলেজ হিসাবে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজএর মতো মহিরুহে পরিণত হয়েছে। এই ২০২৩এ  চলছে এই প্রতিষ্ঠানের সার্ধশত বার্ষিকি উদযাপন। 


 এই দেড়শ বছরের এই দীর্ঘ সময়ে কলেজ জন্ম দিয়েছে বহু কৃতি ছাত্র তথা প্রথিতযশা চিকিৎসকের। স্যার নীলরতন সরকার (১৮৬১-১৯৪৩), ডা. হৈমবতী সেন,  ডা. রামচন্দ্র দত্ত, উনিশশ বাহাত্তর সালের ব্রোঞ্জ জয়ী ওলিম্পিক হকি দলের সদস্য ডা. ভেস পেজ, প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার ডা. গীতা ঘোষ, প্রভৃতি বহু বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতি চিকিৎসক এই মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে ছাত্র জীবন সম্পুর্ন করেছেন। অন্যদিকে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ চিকিৎসা গবেষণার একটি তীর্থ ক্ষেত্র।


১৯১২ সালে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ স্যার কেদারনাথ দাস বাঙ্গালী মহিলাদের পেলভিসের উপযোগী ডেলিভারির জন্য একটি ফরসেপ আবিষ্কার করেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে যেটি ‘দাসেস ফরসেপ’ বা বেঙ্গল ফরসেপ নামে পরিচিত। এর প্রায় দশ বছর পর এই হাসপাতালে গবেষনা করেই স্যার উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী ১৯২২ সালে মারণ রোগ কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেন। গবেষণার এই ধারা বজায় থাকে স্বাধীনতার পরেও। পঞ্চাশের দশকে প্যাথোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শম্ভুনাথ দে আবিষ্কার করেছিলেন কলেরা টক্সিন আর এই কলেজে চাকরি করার সময়ে ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়এর  গোপনে গবেষণার সুবাদে জন্ম হয় ভারতের প্রথম নলজাতক দুর্গার। এছাড়াও ইদানিং কালে সদ্যজাতের চিকিৎসা, জোড়া নবজাতককে আলাদা করা বা হার্টের ভাল্ভ রিপ্লেসমেন্টের মতো যুগান্তকারী চিকিৎসায় এই শহরে এই মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ও চিকিৎসকরাই প্রথম পথ দেখান। বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ডা বিধানচন্দ্র রায় ১৯১২ থেকে ১৮ এই কলেজের শিক্ষক ছিলেন। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সুবীর চট্টোপাধ্যায়, ধাত্রী বিদ্যার অধ্যাপক ডিসি দাঁ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. সমীর বিশ্বাস বা বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তির মতো বহু প্রবাদপ্রতীম চিকিৎসক বিভিন্ন সময়ে এই কলেজের অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেছেন।  


ছবি সৌজন্যে: শুভ ঘোষ

বর্তমানে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের প্রায় সাঁইত্রিশটি বিভাগে এমবিবিএসে ২৫০ জন ও এম ডি ও এমএসে প্রায় ১২২ জন ছাত্র পড়াশোনা করতে পারে। ডিএম ও এমসিএইচ কোর্সে আসন রয়েছে যথাক্রমে ১৬ ও ১৫টি। ১৯২০ শয্যার এই হাসপাতালে শুধু বর্হি বিভাগেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার হাজার সাতশ মানুষ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখাতে আসেন। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে দিন রাত চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা মানুষের সেবা করে চলেছেন।

সারা বছর ধরেই চলছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্ধশত বার্ষিকি উদযাপন। এরই মধ্যে আগামী ১০ থেকে ১২ই ফেব্রুয়ারি এন আর এস মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজ এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ১৫০ বছর উদযাপন কমিটির  উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠান হতে চলেছে। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। দশ তারিখের মূল অনুষ্ঠান ছাড়াও এই তিনদিনের বিভিন্ন সায়েন্টিফিক সেশন ও ওয়ার্কশপে তাঁরা যোগদান করে অভিজ্ঞতা ও মত বিনিময় করবেন।  

এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত কলকাতা প্রেস ক্লাবের এক সাংবাদিক সন্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সভাপতি ডা. অভিজিত ঘোষ, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ডা. সৌরভ দত্ত, সহ সভাপতি ডা. মানস গুমটা, ডা. দ্বৈপায়ন মুখার্জি, ডা. সৌরেন পাঁজা, ডা. অমিত দাস, ডা. সুজয় ঘোষ ও ডা. সত্যদিপ মুখার্জীর মতো বিশিষ্ট চিকিৎসক ও প্রাক্তণ ছাত্ররা। সন্মেলনে বিভিন্ন বক্তারা কলেজের অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন দিক এবং কলেজ সম্পর্কে এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভবিষ্যত পরিকল্পণা সন্মন্ধে বক্তব্য রাখেন।

Comments